১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। মাঝ দুপুরের আগেই বিজয়ের খবর ছড়িয়ে গেল। মুক্তির অনন্দ-উল্লাস, স্বাধীন ঢাকা শহর ঘুরে দেখার জন্য দলবদ্ধ, দলছুট হয়ে ছুটছে মানুষ। বন্ধু একত্রিত, ছিটকে অন্য বন্ধুদের আপন করে নেয়া, কিছু ঘটনা, কিছু দুর্ঘটনা ৬০+- বয়সের সবারই জানা।
সম্ভবত ২০ ডিসেম্বর, হটাৎ কমান্ডার নাজমুল কবির ডাকলেন ৫ জনকে - আমি (হিরু), দুলাল, বুলবুল, পল্টু এবং আজিজ জুনিয়র হলেও পাকামো ছিল, সঙ্গে লেগে থাকতো। আমি বাসা থেকে বেরুবার সময় কিছুটা অবাক হলাম, নাজমুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার তেমন বন্ধুত্ব ছিল না, যেমন ছিল দুলালের সঙ্গে। পল্টুর সঙ্গেও ঘনিষ্টতা ছিল। আমি মাঝখানে কি কারণে তলব পেলাম - কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়েই রওনা হলাম আল-হেলাল জোনের মাদ্রাসার সঙ্গে লাগোয়া ছোট অফিস ঘরে। নাজমুল ভাই বসা। পেছনে সম্ভবত মিরপুর থেকে আসতো, স্বাস্থবান একজন দাঁড়িয়ে ছিল।
নাজমুল ভাইয়ের সঙ্গে সবার কিছু আলোচনা হলো। বললেন, শহরে ল-এন্ড-অর্ডার তেমনটি নেই। মানুষের হাতে স্মল এন্ড মিডিয়াম আর্মস রয়েছে। উদ্দেশ্য খারাপ থাকলে কলোনির যে কোনো বাসায় অস্ত্রের মুখে ডাকাতি বা অন্য কিছু হতে পারে। তোমরা ৫ জন আর্মড হয়ে সারারাত আল-হেলাল জোনে পাহারা দিবে। একটু রিস্ক থাকবে। ২ দলে ভাগ হয়ে সিঁড়িঘর, দু'বিল্ডিং-এর পেছনে, মাঝখানে ঘুরে ঘুরে দেখবে, বিপদে পড়লে বাঁশি বাজাবে, একে অন্যকে কভার দিবে। ডিউটি প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত। রাইফেল রাত ১০ টায় বুঝে নিতাম, সকাল ৬ টায় ফেরত দিতাম।
আমাদের সম্মতি পেয়ে নাজমুল ভাই ৫ জনকে ৫ টা গুলি ভরা থ্রী-নট-থ্রী রাইফেল চেক করে হাতে তুলে দিলেন। নাহ, কোনো আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এই দায়িত্ব অর্পণ করেন নি। তখনও নাজমুল কবির ভাই রমনা থানার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং সেই ক্ষমতাবলে সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আনুষ্ঠানিকতার সময় বাইরের কোনো মানুষকে রুমে ঢুকতে দেননি।
আমাদের কার পদবি কি ছিল তা' প্রকাশিতব্য ব্যাপার না এই মুহূর্তের লেখনীতে।
পাহারা ভালোই চলছিল। দুলাল-আমি একসঙ্গে, (মেজর)বুলবুল, পল্টু, আজিজ একসঙ্গে। মাঝে মাঝে ক্রস হতো, বা একত্রিত হয়ে কথা বলতাম, খাবার থাকলে খেতাম, একরাতে (২টা) আমার ভলিবলের ওস্তাদের বাসায় লাইট জ্বলা দেখে নক করলাম, পানি খাবো। কিছুটা ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন , কে? বললাম হিরু। দরজা খুললেন, পানি খেলাম, মনে হয় হালকা কিছু খাবার দিয়েছিলেন। বিল্ডিঙটা পল্টুদের, বি-২০/জি-৩। ঘটনাকে উপন্যাস বা ফিল্মি স্টাইল করতে চাই না।
আমি ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারে জিমন্যাস্টিক করতাম। ৩০ ডিসেম্বর ভল্ট-বক্স থেকে পড়ে গিয়ে ভালোই আহত হলাম। বাসায় ফিরে দেখলাম জ্বর। দুলালকে বললাম, তুই আজকে কমান্ডারের ডিউটি কর, দরকার হলে একজনকে সঙ্গে নিবি। দুলাল সম্মত হলো, প্রচন্ড সাহসী এই দুলাল।
আজিজ-এর বাসা আমার পাশেই, ২০ ফুট দূর হবে. মাঝরাতে মা চিৎকার দিয়ে বললো-হিরু উঠ, আজিজের গুলি লেগেছে। লাফ দিয়ে উঠেই ওদের বাসে ঢুকে দেখলাম আজিজ রক্তের উপর শুয়ে আছে। থ্রী-নট-থ্রী-র গুলি, বুকে ঢুকেছে ছোট ফুটো করে, পিঠ দিয়ে বের হয়েছে বিশাল জায়গা জুড়ে মাংস ছিন্ন-ভিন্ন করে। আমাদের প্রিয় আজিজ ঝরে গেলো।
নাজমুল ভাই এবং অপরিচিত সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে কিছু নির্দেশ দিলেন। পালন করলাম। সেই রাতের পর আল-হেলাল জোনের সশস্র পাহারা বন্ধ হয়ে গেলো। পরদিন আজিজকে সমাহিত করা হলো বর্তমান মাসজিদ সংলগ্ন মার্কেটের পাশে।
|